Wednesday, July 22, 2015


| ভারত-পাক যুদ্ধ পোড়া মাটির ঢেলা দিয়ে
ইষ্টভৃতি ||
---------------^^^^^^^-----------------
শ্রীশ্রীঠাকুর সকালবেলা পার্লারে বসে আছেন।
১১ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৬। হীরেন কুমার মিত্র
নিবারন চন্দ্র তালুকদার নামে দুই যুবক এসে শ্রীশ্রীঠাকুরকে প্রণাম করে বসলেন। তারা 
সৈনিক। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাক যুদ্ধে 
লাহোর সেক্টরে ভারতীয় সৈনিক হিসাবে লড়াই করেছেন। হীরেনের ডাক নাম কালো, সে সৎনামে দীক্ষিত। তার বন্ধু নিবারন দীক্ষা নেওয়ার জন্য হীরেনের সাথে ঠাকুরের কাছে এসেছে।
শ্রীশ্রীঠাকুর - তোরা ভাল আছিস্? গল্প কর। শুনি। তোরা কোথায় ছিলি কি করলি?
কালো -ঠাকুর! আমরা ৫ই সেপ্টেম্বর (১৯৬৫)
অমৃতসরের কিছু দূরে 'ক্ষেমকরন' সেক্টরে ছিলাম
তা পাক সীমানার কাছাকাছি। ওখান থেকেই আমরা পাক-সীমানার মধ্যে ঢুকে পড়ি। আমাদের সাথে সমরাস্ত্র ছিল অনেক
জ্ঞান দা(সেক্রেটারি সৎসঙ্গ)- কী কী মারনাস্ত্র ছিল?
কালো- জি.পি, স্রেভ, ফিউজ, ডিটোনেটর, অটোমেটিক রাইফেল ইত্যাদি। আমরা ৪৫মিনিটের মধ্যে একটা 'বেলী' ব্রীজ তৈরী করি। কারন, ওটা না হলে জলাশয় টপকে আমদের গাড়ি যাওয়ার অসুবিধে। ১টন(হাজার কেজি) ওজনের গাড়ি তার ওপর দিয়ে সচ্ছন্দে চলে যেতে পারে। ঐভাবে জলাশয় পার হয়ে আমরা "এ্যারো-হেড্ ফরমেশন"( Arrow- head formation) করে পাক সীমানার দুই মাইল ভিতরে ঢুকে পড়ি। পাকিস্তানের একটা ব্রীজ ছিল দিকটায়। তা আমাদের নষ্ট করে দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল। আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলেছে। হঠাৎ শত্রুপক্ষেরর একটা গুলি এসে আমাদের গাড়িতে একজন সৈনিকের
(
সর্দারজী) হাতে লাগে। তখন ভোর সাড়ে পাঁচটা। আমরা ভোর প্রায় সাড়ে চারটের সময় রওনা দিয়েছিলাম। গুলিটা সিং-এর ডান হাত দিয়ে ঢুকে বাম হাত দিয়ে বেরিয়ে যায়। রক্ত বের হতে লাগল। আমরা তখন সিং-কে স্থানীয় গ্রামের একটি বাড়িতে রেখে দিলাম। তাকে দেখবার জন্য একজন সৈনিককে রেখে আমরা এগিয়ে চললাম। গ্রামে মাত্র একজন বুড়ি ছিল। আর সব পালিয়ে গেছে। কত মিষ্টি আর ভাল ভাল খাবার সব পড়ে আছে। রেডিও, ঘড়ি
,
টেপরেকর্ডার ইত্যাদিও সব পড়ে আছে। ঐসব আমাদের স্পর্শ করা নিষেধ ছিল। খুব খিদেও পেয়েছে। কি করি!
ইষ্টভৃতি করব তার পয়সাও নাই। সামনে একটা উনুন দেখলাম। তার কিছু পোড়া- মাটিও দেখলাম। পোড়ামাটির একটি ছোট্ট ঢেলা হাতে নিলাম। তা নিয়ে ইষ্টভৃতির মন্ত্র জপ করে ঢেলাটি বুক-পকেটে রাখলাম। তারপর শুধু জল খেলাম
শ্রীশ্রীঠাকুর খুব উৎসুক হয়ে সব শুনতে লাগলেন এবং কালোর দিকে চেয়ে মৃদু হাসছিলেন
কালো- আমরা এগোচ্ছি। হামাগুড়ি দিয়ে যাচ্ছি। জলা জায়গা। হঠাৎ অদূরে গাছের মধ্যে একজন O.P.(,পি)-কে দেখলাম
ঠাকুর- O.P. (,পি) কি?
কালো -অবজারভেশন পোষ্ট (Observation Post) গাছের ডালের আড়ালে লুকিয়ে শত্রুপক্ষেরর এক সৈনিক আমাদের অবস্থানের সব খবরাখবর ওদের হেড অফিসে দিচ্ছিল।
তাকে ঐভাবে দেখে আমাদের দলের লোক জিজ্ঞাসা করল - ওকে গুলি কোরব? মেজর সাহেব বললেন- না, না। মনে হয় বর্ডার পুলিশ।তখন আমাদের দলের লোক বলল - না, শত্রুপক্ষীয় লোক। সব পরখ করে ওয়ার-
লেসে শত্রুপক্ষকে সব সংবাদ দিচ্ছে। আমাদের পজিশনের ডিরেকশন, ডিগ্রি, অ্যাঙ্গেল, এলিভেশন (Direction, Degree,Angle, Elevation) ইত্যাদিও লোকটি শত্রুপক্ষকে জানিয়ে দিচ্ছে।ওরই নির্দেশে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি আমাদের এদিকে আসছিল মনে হয়। অবশেষে ওকে মেজরের নির্দেশে ওকে গুলি করে মেরে ফেলা হল। তার একটু বাদেই আমাদের দিকে একটা গ্রেনেড এসে পড়ল
জ্ঞান দা- গ্রেনেড কি ?
কালো - গ্রেনেড হল হাত বোমা। ছোট।ডিমের মত সাইজ অনেকটা। ওটা ফাটলে ২০০/২৫০ গজের মধ্যে যারা থাকে তারা সবাই আহত বা নিহত হয়। কিন্তু কি ভাগ্য ঠাকুর! ওটা এসে কাদার ভেতরে ঢুকে গেল। ফাটল না। তাই বাঁচলাম ঠাকুর ! প্রাণপনে আপনার নাম করছি। আমাদের মেজর সাহেব আদেশ দিলেন একটু নিরাপদ স্থানে পিছিয়ে আসার জন্য। আমরা তখন তাই করতে লাগলাম। কাদায় পা ডুবে যাচ্ছে। খিদে পেয়েছে খুব। অনবরত মাথার উপর দিয়ে গুলি চলছে। শরীর আর চলছে না, এভাবে ফিরে এসে আমাদের এলাকায়
(
হিন্দুস্থানে) একটা ট্যাঙ্কের নীচে আড়াল করে বসলাম। এমন সময় হিন্দুস্থানের (ভারত) গ্রামের কিছুলোক আমাদের জন্য রুটি আচার নিয়ে এল। আমরা তা খেয়ে জামাপ্যান্ট রোদে দিয়ে একটু বসেছিলাম। পাকিস্থানীরা এবার আমাদের ট্যাঙ্ক ফায়ার করতে লাগল। আমরা তাড়াতাড়ি
প্রস্তুত হয়ে নিলাম। অন্য জায়গায় গাছতলায় গিয়ে পজিসান নিলাম
জ্ঞান দা - তারপর?
সহসৈনিক নিবারন তালুকদার বলল- কিছু সময় পরে ওদের ( পাকিস্তানী) বিমান আসে। বোমা ফেলতে থাকে উপর থেকে। কালো একটু অদূরে থাকে। আমি বেলী ব্রীজের (যা আমরা তৈরী করেছিলাম) উপর দিয়ে হেঁটে জলাশয় পার হয়ে আসছিলাম। ব্রীজটাকে লক্ষ্য করেই ওরা বোমা ফেলছিল। ব্রীজটার বাম দিকে বোমাটা পড়ল। আমি ব্রীজটার ডানপাশ ঘেঁষে ছিলাম। বোমার শব্দ শুনেই এবং লোহার টুকরা এসে পড়বে এইভেবে জলের মধ্যে ডুব দিঢে থাকলাম। আমার কিছুই ক্ষতি হয় নি। বোমা পড়ার সাথে সাথেই অনেকখানি জল 
উপরে উঠে গেল। আমাদের একজনের খুব ক্ষতি হয়েছে। লোকটি উপরে ছিল। আড়াল নেবার জন্য দৌড়াচ্ছিল। সময়মত দৌড়ে গিয়ে তা নিতে পারে নি তাই জখম হল
ঠাকুর- তারপর তোরা কি করলি?
কালো- আমাদের মনের অবস্থা এমন হল যে মরণ কে আর ভয় করছি না। মরণ তো আছেই।
ভয় নাই। মরে মরব। আমরা সবাই উঠে এলাম। গ্রামের লোকেরা শুকনো রুটি নিয়ে এল। ছোলা ভাজা দিল।বিড়ি সিগারেট একজন আরেকজনকে দিচ্ছে। মনের অবস্থা তখন ভালই।.......
জ্ঞানদা- সাহস তখন আপনিই আসে
কালো - আমরা আমাদের সীমানার মধ্যে আছি। আমাদের উপর আদেশ চিল যে-কোন রকমেই হোক 'ক্ষেমকরণে' খালের পুলটাকে উড়িয়ে দেওয়া।আর মূখ্য উদ্দেশ্য- সোজাসুজি
লাহোরে যাওয়া। শিয়ালকোট দিয়ে আমাদের সৈন্যরা লাহোরের রেডিও স্টেশনের কাছে চলে গিয়েছিল। তারা শিয়ালকোট দিয়ে আক্রমন
করে। পাকিস্তানী একজন সৈনিক ( বোধ হয় কোন অফিসার হবে) ইন্ডিয়ান মেজরের ইউনিফরম পরে শিয়ালকোট সেক্টর ইউনিটের ইন্ডিয়ান সৈন্যদের বলেছিল - তোমরা শীঘ্রই এখান থেকে রিটায়ার কর। এখানে পাক সৈন্যের জোর খুব বেশী আসলে লোকটি পাকিস্থানের পক্ষে এসব কথা বলছিল। পাকিস্তানের কোন সৈন্যই ওখানে ছিল না। একজন উচ্চপদস্থ অফিসারের কথা মানতেই হয়। তাই ইউনিটের সৈন্যরা তা পালন করল।
সময়ের মধ্যে এসে পাক সৈন্যরা ডিফেন্স পজিসান নেবার সুযোগ পেয়ে গেল। যেভাবে আমাদের সৈন্যরা এগিয়ে যাচ্ছিল তাদের গুলি লাহোর পার হয়ে চলে যাচ্ছিল। পাকিস্তানি 
হাওয়াই জাহাজ এসে শিয়ালকোটে আমাদের অসামরিক কর্মচারীদের উপর বোম্বিং করে। আমাদের ফাইটারগুলো কখনো পাকিস্তানি civilian -দের(অসামরিক কর্মচারীদের) উপর বোমাবর্ষণ করে নি বা আক্রমন করার চেষ্টাও করেনি
জ্ঞান দা- তারপর?
নিবারণ তালুকদার - আমরা ১২ তারিখ পর্যন্ত্য (১২//১৯৬৫) ডিফেন্স বানিয়েছি। ১৩//১৯৬৫ তাং ভোর ৫টায় আবার আক্রমণ করার জন্য এগিয়ে যাচ্ছি। মাইন ফিল্ড
লাগাতে লাগাতে অগ্রসর হচ্ছি। পাকা রাস্তা উড়িয়ে দেওয়ার জন্য অগ্রসর হলাম। আমাদের ট্যাঙ্ক পাকিস্তানি ট্যাঙ্কের চেয়ে ছোট। আমাদের সেলগানের সহায়তায় পাকিস্তানের ১৬/১৭ টা প্যাটন ট্যাঙ্ক নষ্ট করে দেওয়া হয়। আমাদেরও কয়েকখানা ট্যাঙ্ক নষ্ট হয়ে যায়।
এরপর পাকবাহিনী / মাইল পিছু হটে যায়। আমাদের জনৈক হাবিলদার সেলগান জিপে করে এগিয়ে পরপর তিনটি পাকিস্তানি প্যাটন ট্যাঙ্ক নষ্ট করে দেয় এবং একজন পাক অফিসার কে গুলি করে সেই অফিসারটি মরে যায়। তার আইডেনটিটি কার্ড আমাদের কমান্ডার সাহেবের কাছে জমা দিলাম। এটাই নিয়ম
জ্ঞান দা - ওরা কি করে?
কালো - তা জানি না। আমরা গর্তের মত করে
তাতে সব মৃত সৈনিকদের রেখে আগুন ধরিয়ে দেই। ওরা তো আমাদের কয়েদিদের মেরেই ফেলে। ওদের একটা কয়েদী ধরা পড়লে আমরা সাথে সাথে ব্রডকাস্ট করে ওদের জানিয়ে দেই।
আইডেনটিটি কার্ড পাঠালে ঐসব কয়েদিদের পরিবার পেনসন পাবে
জ্ঞান দা - হাবিলদার কি করল?
কালো- উনি ভয়ানক সাহসী। দেশপ্রমে ভরপুর। আমরাও সব মরিয়া হয়ে উঠেছি। হঠাৎ একটা গুলি হাবিলদারের মাথায় এসে লাগে। তখন উনি চিৎকার করে বলতে থাকেন- " ভারতকা জওয়ান। ঘাবরাও মাৎ। ডাট্ কর লড়। হামারা ভারত সদা মেহনতকা রোটি খায়ে। ইসি আজাদিকে নামপর য়ো মেহনতকা ফায়দা উঠায়েঙ্গে।" তিনি ছটফট করছেন আর দাড়িঁয়ে দাড়িঁয়ে চিৎকার করছেন। ঠিকমত পজিসান নেন নি। ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি আসছে। হঠাৎ একটা গুলি তার বুকে এসে লাগে। তাতে তিনি মরে যান। আমরা সবাই পজিসান নিয়ে নিলাম। ওনার মৃত্যু দেখে আমাদের উৎসাহ আরো বেড়ে গেল। আমরা সবাই আবার এগোতে শুরু করলাম। শেষ পর্যন্ত্য পাকিস্তান আমাদের উপর হাওয়াই হামলা শুরু করল। তখন Infantry (পদাতিক সৈন্যবাহিনী) ছত্রভঙ্গ হল। অনেক লোক মারা গেল। ওদের মধ্যেও অনেকে স্বেচ্ছায় কয়েদী হয়েছে। একটি পাকিস্তানি ছেলে পাজামা পড়ে যুদ্ধে এসেছে। সে বলল - আমরা অনেকে পোষাকও পাইনি। এমনকি লাঞ্চ রাখার জন্য একটি ঝোলাও আমাদের দেওয়া হয় নি। শুধু মরবার জন্যই আমাদের পাঠাত। ছেলেটি কয়েদ হয় ভুল করার জন্য। হাওয়াই আক্রমণ করার দরুন আমাদের বহু সৈন্য ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় চারিদিকে
তারাই কয়েদ হয়েছে। তাদের চোঁখ বেঁধে নিয়ে যায়
প্রশ্ন~ চোখ বেঁধে নিয়ে যায় কেন?
নিবারণ তালুকদার -শত্রুপক্ষের কোন গোপনীয়
তথ্য জেনে যেন বলতে না পারে যুদ্ধের পরে।
Cease Fire (
যুদ্ধবিরতি) হওয়ার পরে ভারতীয় সৈন্যদের তরফ থেকে কোন গুলি ছোঁড়া হয়নি।
কিন্তু পাকসৈন্যরা গোপনে এসে ভারতের গ্রামের লোকেদের উপর অত্যাচার করেছে।'নো ম্যানস ল্যান্ড' ভারত ছেড়ে দিয়েছে। সেখানে আমাদের কোন সৈন্য ছিল না। লড়াইও হয় নি।
ফজুল কা বাংলার (ফিরোজপুর অঞ্চলে) সামনে জাতীয় ঘটনা ঘটেছে। ওরা যুবতী মেয়েদের ধরে নিয়ে গেছে।একটা কলেজকে ঘেরাও করে ৮০ জন মেয়েকে নিয়ে যায়। খালের উপর দিয়ে যখন মেয়েদের নিয়ে যাচ্ছিল তখন ওদের মধ্যে অনেকে খালের জলে ঝাপ দেয়। জলের মধ্যে পড়েও মেয়েরা "ওহাই গুরু" বলে চিৎকার করেছে। কয়েকটি মেয়ে জলের স্রোতে পড়ে মরেও গেছে। যারা জলে পড়েও বেঁচে ছিল তাদেরও ওরা ধরে নিয়ে যায়। একদিন পর নানাধরনের অত্যাচার করে অর্ধমৃত অবস্থায় ওদের ছেড়ে দেয়। আমরা তাদের দেখেছি। আমরা প্রায় ২০০ মাইল গাড়ি করে স্থানে গিয়েছি। এই সমস্ত কান্ড দেখে আমাদের গুর্খা রেজিমেন্ট বর্কী শহরটাকে (পাকিস্তানের মাইল ভেতরে) ঘেরাও করে। সেখানে সব লোককে কয়েদ করা হয়। প্রায় / ' হবে সব মিলিয়ে। মেয়েরা প্রানের ভয়ে চিৎকার করে ওঠে। আমাদের কমান্ডার আদেশ দিয়েছিলেন - মেয়েরা মাতৃজাতি। ওদের উপর কোন অত্যাচার করবে না। আমাদের ভারতীয় সৈন্যরা তাদের উপর কোন অত্যাচার করেনি। তাদের সসম্মানে ভারতীয় জেলখানায় রাখা হয়
জ্ঞান দা - তাসখন্দ চুক্তির পর সৈন্যদের মনের অবস্থা কেমন?
নিবারণ - তখন পাকিস্তানি ফৌজরা হিন্দুস্থানী ফৌজদের সাথে হাত মেলায়। ওরা বলেছে আমরা উভয়ে ফৌজ। আমাদের কিসের ঝগড়া? আমরা তো আদেশ পালন করেছি মাত্র
শ্রীশ্রীঠাকুর তামাক খাচ্ছেন
কালো শ্রীশ্রীঠাকুরকে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল-
ঠাকুর তিনদিন আমি খালের মধ্যে পড়েছিলাম। বাঁধের মধ্যে কেবল গুলি এসে পড়েছে। আবার উপর থেকে হাওয়াই হামলা শুরু হয়েছে। সেদিন ভাবলাম - ঠাকুর! আজ বুঝি আর বাঁচব না। কেবল "ঠাকুর", " ঠাকুর" করছি। আপনাকে স্মরণ করেছি। আপনার দয়াতে বেঁচে এসেছি। আমার ভীষণ অভিজ্ঞতা হল। ঠাকুর! আমি এখন কি করব? আমার বন্দুক নিয়ে নাড়াচাড়া করতে খুব ভাল লাগে। আমি কি এই লাইনেই থাকব? Artillery (গোলন্দাজ সৈন্য) আমার ভাল লাগে
শ্রীশ্রীঠাকুর - তোর তো হাত খুলে গেছে। যাবি না কেন? যাবি
কালো - বুড়ো বয়সে কি হবে?
শ্রীশ্রীঠাকুর - ভাল করে কাজ কর। কাজ শেখ।
বুড়ো বয়সে কী হবে তা ভাবিস কেন? স্ফূর্তিতে কাজ কর
কালো - আমার সঙ্গী নিবারণ দীক্ষা নেবে
শ্রীশ্রীঠাকুর - খুব ভাল
খানিকবাদে ঠাকুর একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন - দেশ-বিভাগের দরুনই এসব কান্ড 'চ্ছে!
শ্রীশ্রীঠাকুরকে বহুদিন বলতে শুনেছি যে এসব রাহাজানি, হানাহানি, যুদ্ধ, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ সবটার মূলে হচ্ছে দেশ-বিভাগ। সুস্থ থাকার পথই হচ্ছে পুনর্মিলন। যে-সব নেতারা মনে করেন যে তাদের কোন ক্ষতি হয়নি দেশ-বিভাগের দরুন, শ্রীশ্রীঠাকুর বলেন ঐসব নেতারা নেতাই নন। যে নেতারা মিলন চায় না তার মানে তাদের সুবিধা আছে। ব্যাক্তিগত সুবিধা আছে। স্বার্থ আছে যার জন্য মিলনের দিকে অগ্রসর হতে চায় না।......
দীর্ঘনি:শ্বাস বেরিয়ে এল ঠাকুরের মুখ থেকে
তথ্য- শ্রীমণিলাল চক্রবর্তী, স্মৃতির মালা
সরযূ নদীতীর আর হেরা পর্বত
ঠাকুর নিত্যদিনের মত আজও(৫ই অক্টোবর,
১৯৬১) সকালে পার্লারে উপবিষ্ট। শ্রদ্ধেয় কেষ্টদার(শ্রীকৃষ্ণপ্রসন্ন ভট্টাচার্য্য, প্রেসিডেন্ট, সৎসঙ্গ) ছোট ছেলে (চাউ) এক সাজি-ভর্তি বড় টগর ফুল এনে শ্রীশ্রীঠাকুরকে প্রণাম করল। ঠাকুর দু'একটা টগর ফুল হাতে নিয়ে বার সাজিতে রেখে দিয়ে কীযেন ভাবতে লাগলেন। মনে হল যেন সুদূর অতীতের কোন ঘটনা তাঁর মনে পড়ে গেল। তিনি বলতে লাগলেন - " সরযূ নদীর তীরে এমন টগর ফুল ছিল। অনেক টগর গাছ। এখানে একটা গাছ, ওখানে একটা গাছ। বনে যেমন হয়। প্রভাতী ূর্যের কিরণ এসে পড়ত সাদা সাদা ফুলগুলির উপর। ভারী সুন্দর দেখাত, লালচে। আবার সুর্য যখন ডুবত, নদীতীর অপূৃর্ব শোভা ধারণ করত। অস্তগামী সুর্যের আভায় সব টকটকে লাল হয়ে যেত।
নদীর পারে পাথর ছিল অনেক। সেগুলিও বেশ সুন্দর, মসৃণ, উঁচু-উঁচু। তার মাঝে একটা বড় বাঁশঝাড়ও ছিল নদীতে প্রচুর জল ছিল। সুগভীর নদী। মেয়েরা সব মাথায় করে জল নিত। কাঁখে নিত না। আমি সেই জায়গায় গেলে এখনও সব চিনব।"
যেন ঠাকুরের পূর্বজন্মের স্মৃতি
পুরুষোত্তম শ্রীরামচন্দ্রসরযূ নদীর তীরে এক সময় থাকতেন। টগর ফুল দেখে...... ঠাকুরের সে-সব কথাই কি মনে পড়ে গেল? উল্লেখ্য, -
এই ঘটনার পরেই ঠাকুর আশ্রমে টগর ফুলের গাছ লাগানোর ইচ্ছা প্রকাশ করেন। আর পরবর্তী বছরগুলোতে বহূ টগর গাছ সারা আশ্রম জুড়ে লাগানো হয়েছিল। কত ফুল ফুটল! দয়ালের আনন্দ দেখে কে?
ঠাকুর আরও বলে যেতে লাগলেন-"আমি আরেকটা জায়গায় ছিলাম। সেখানে পাহাড় ছিল। সেই পাহাড়টার চারিদিকে আরো -৪টে পাহাড় ছিল। আমি সেখানে একটা পাথরের ওপর গিয়ে বসতাম। যে পাথরটায় বসতাম তা লতায় ঘেরা ছিল। লতায় লতায় যেন মিলে গেছে। ঝর্ণাও ছিল। জল পড়ছে। সেখানে বসে আমি একা একা বহুদিন সাধনা করেছি। হিংস্র জন্তুও সে-সব পাহাড়ে ছিল। আমি সেখানে খোদার চরণে করুণভাবে প্রার্থনা জানাতাম...
অঞ্চলে গেলে মনে হয় এখনও সব চিনতে পারব। "
এখানে দয়ালঠাকুর কি হেরা পর্ব্বতের কথা বলেছেন? রসুল হেরা পর্বতে গিয়ে বসতেন খোদার উদ্দেশ্যে প্রার্থনা জানাতেন। জানি না এই মহামানব কে? তবে তাঁর এই নয়নাভিরাম
অভিব্যক্তি নিজের চোখে দেখে-বুঝে একটা কথাই মনে হয়েছে যে -সবই তাঁর আত্ম- পরিচয়। কচিৎ কখনো বিদ্যৎু ঝলকের মত জাগতিক সাধারণ ঘটনার সূত্র ধরে তিনি আমাদের কাছে এভাবে ধরা দিতেন। উপস্থিত পরম সৌভাগ্যবান যৎসামান্য ভক্তমন্ডলী যেন সেই টাইম-মেশিনের যাত্রী। আজও সেই সব দৃশ্য স্মৃতিতে উজ্জল
লেখক- মণিলাল চক্রবর্তী, স্মৃতির মালা